ইয়াসিন আরাফাত :
কুমিল্লা জেলার ৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর পরই তিন উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী ফের নির্বাচনের দাবিতে মানববন্ধন করেছে তিন প্রার্থী। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা ও দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় এমপির প্রভাবে ভোট কারচুপি, অনিয়ম, সেন্টার দখল করে ফলাফল ছিনিয়ে নিয়ে নিজস্ব প্রার্থীদের বিজয়ী করার প্রতিবাদে ও ভোটের ফলাফল বাতিল করে পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছেন পরাজিত তিন প্রার্থী।
রবিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে এই সংবাদ সম্মেলন করেন কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা নির্বাচনে আনারস প্রতীকের প্রার্থী ব্যারিস্টার সোহরাব খান চৌধুরী এবং দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী শাহিদা আক্তার ও দোয়াত কলম প্রতীকের প্রার্থী খাদিজা বিনতে রওশন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে ব্যারিস্টার সোহরাব খান চৌধুরী বলেন, ষষ্ঠ উপজেলা নির্বাচনের ৩য় ধাপে সারাদেশের বিভিন্ন উপজেলার সাথে কুমিল্লা-৫ ও কুমল্লা-৪ নির্বাচনি এলাকার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা ও দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদে গত ২৯ মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে কুমিল্লা থেকে প্লট এঁকে কুমিল্লা জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও স্ট্রাইকিং ফোর্সসহ এমনই এক ছকে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার নির্বাচনি দায়িত্ব পালনের জন্য পাঠানো হয়। আমাদের স্থানীয় এমপি (কুমিল্লা-৫) প্রশাসনকে বায়াসড্ করে প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার দিয়ে নির্লজ্জভাবে ও কুমিল্লা শহরের সন্ত্রাসীদের এলাকায় এনে জোরপূর্বক কেন্দ্র দখল করে সিল মেরে আমার আনারস প্রতীকের নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নেয়।
তিনি বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন যাতে এমপির স্বজনরা উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী না হয় এবং নির্বাচন অবাধ এবং সুষ্ঠু করতে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় এমপি আবু জাহের তার আপন ভাতিজা অপিকে (ঘোড়া প্রতীক) বিজয়ী করার জন্য পরিকল্পনা করে কুমিল্লা শহরের সমস্ত পুলিশের ডিউটি বিন্যাস করা হয়। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার প্রতিটি কেন্দ্রে এমনকি প্রশাসনিক সুবিধা নিতে জেলা প্রশাসনকে দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটগুলোকে নিয়োগ করা হয় ও ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলা প্রশাসনের প্রকাশ্য সহায়তা নিয়ে আমাকে পরাজিত করিয়েছে।
আনারস প্রতীকের এই প্রার্থী বলেন, দুপুর দুটার পর প্রিজাইডিং ও সহকারী প্রিজাইডিং অফিসাররা নিজেরাই নির্লজ্জভাবে ভোট কেটে ঘোড়া প্রতীকে সিল মেরে ভোট বাক্সে ঢুকিয়েছে প্রায় প্রতিটি কেন্দ্রে। তার মধ্যে সারাদিনই প্রক্সিভোট দেওয়া তো লেগেই ছিল। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর নিজ এলাকা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের তালিকা দেওয়া সত্ত্বেও সেখানে প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। উপরন্তু ছাপ্পা মেরে ভোট কেটে নিতে উৎসাহী হয়ে ব্যালটে ঘোড়া প্রতীকে সিল মেরে ভোট বাক্সে ঢুকিয়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, আমার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ঘোড়া প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা আবু তৈয়ব অপির চাচা স্বতন্ত্র এমপি আবু জাহের নির্বাচন কমিশনকে তোয়াক্কা না করে আচরণবিধি লঙ্ঘন করে ভাতিজার পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণা চালিয়েছেন। টি আর কাবিখা বা বিভিন্ন বরাদ্দ দেওয়ার নাম করে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদেরকে ও সাধারণ জনগণকে, যা জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু জেলা ও উপজেলা নির্বাচন কমিশনে বারবার অভিযোগ করেও কোনো ফলাফল পাইনি। নির্বাচনি প্রচারণার পুরোটা সময় এমপি জাহের স্থানীয় ও কুমিল্লা শহরের সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছে। তারপরও যেহেতু ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার জনগণ আমার পক্ষে ছিল, তাই সকল ভয়ভীতির ঊর্ধ্বে উঠে আমি নির্বাচনি প্রচারণার মাঠে ছিলাম।
তিনি বলেন, বিশ্বাস ছিল প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে প্রশাসন নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ করবে। কিন্তু নির্বাচনের দুই দিন আগে থেকেই স্থানীয় এমপির সন্ত্রাসী বাহিনী বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে নিষেধ করে বলেছে, কেন্দ্রে লাশ পড়বে, বিরাট গণ্ডগোল হবে ইত্যাদি। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রিজাইডিং অফিসারসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গণতন্ত্রের কবর রচনা করে এমপির ভাতিজার পক্ষে কাজ করে এবং তাদের ঘোড়া প্রতীকের পক্ষে প্রকাশ্য সিল মেরে বাক্স ভরাট করতে সহায়তা করে। অধিকাংশ কেন্দ্র থেকে সকাল সাড়ে ৯টার মধ্যেই আমার আনারস প্রতীকের এজেন্টদের বের করে দেয়। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী ইউনিয়নগুলোর কেন্দ্রগুলোতে চোরাকারবারি ও মাদক বিক্রেতা ও মাদকসেবীদের কেন্দ্রের বাইরে পাহারায় বসিয়ে তারা ভেতরে ঘোড়া মার্কার সিল মেরেছে।
ব্যারিস্টার সোহরাব খান বলেন, এই সরকারের কমিটমেন্ট ছিল ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচনের। কিন্তু জেলা প্রশাসনের নিরঙ্কুশ ছত্রছায়ায়, ম্যাজিস্ট্রেটদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনুকূলে রেখে ভোট কাটার মহোৎসবে মেতে ওঠেন এমপি ও তার ভাতিজা আবু তৈয়ব অপি। ভোট চলাকালীন সময় কুমিল্লা শহরের বহিরাগতরা এসে দুপুর ২টার পর ভোটকেন্দ্র দখলে নেয় এবং ভোট কাটায় অংশ নেয়। তাতে প্রিজাইডিং পোলিং এজেন্টরা মিলে সহযোগিতা করেন।
তিনি বলেন, যেহেতু গত ২৯ মে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় জনগণ ভোট দিতে পারেনি, তাই আমি এই নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, যদি নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচন বাতিল না করে তাহলে ভোটের প্রতি মানুষের এখনো যেই ন্যূনতম আস্থা আছে সেটাও নষ্ট হয়ে যাবে। এমনিতেই একটি অংশ রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভদ্র লোকেরা আর নির্বাচন করতে আসবে না। গণতন্ত্রের স্বার্থে এবং মানুষের ভোটাধিকার রক্ষা করার স্বার্থে মাননীয় প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহোদয়ের কাছে পুনরায় কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে দেবিদ্বার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রায় একই কাহিনি করা হয়েছে বলে জানিয়ে ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী শাহিদা আক্তার ও দোয়াত কলম প্রতীকের প্রার্থী খাদিজা বিনতে রওশনও ভোটের ফলাফল বাতিল করা হয়েছে।